সেভার্স ও লুসান/লুজান সন্ধির তুলনামূলক আলোচনা
সেভার্স এবং লুসেনের চুক্তি (Treaty of Sevres & Treaty of Lausanne)
সেভার্স ও লুসেনের চুক্তি তুরস্কের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সেভার্সের চুক্তি ছিলো তুরস্কের জন্য খুবই অপমানজনক ও হতাশাজনক। কিন্তু, তুর্কী জাতীয়তাবাদী নেতা মোস্তফা কামাল পাশা লুসেনের (১৯২৩ সাল) সন্ধির মাধ্যমে তুরস্কের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে যথেষ্ট সফল হন।
সেভার্সের সন্ধি (১৯২০ সাল)
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে (১৯১৪ – ১৯১৮ সাল) অক্ষ শক্তির পরাজয়ের ফলে তুরস্কের যথেষ্ট ক্ষতি হয়। কারণ তুরস্ক জার্মানীর পক্ষে অক্ষ শক্তিতে যোগদান করে। কিন্তু, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মিত্র বাহিনী জয়লাভ করলে তুরস্ক সমূহ বিপদের মুখে পড়ে। অক্ষ শক্তির অন্যান্য সদস্যের মতো তুরস্ক ও মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। তুরস্কের প্রায় সব প্রদেশগুলো ও তার রাজধানী মিত্র বাহিনীর দখলে এসে যায়। ১৯২০ সালের ১০ আগস্ট তুরস্ক মিত্র পক্ষের সাথে "সেভার্সের সন্ধি” করে।
সেভার্স সন্ধির শর্তাবলি
১৯২০ সালের ১০ আগস্ট ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের সন্নিকটে সেভার্স (Severes)-এ তুরস্ক ও মিত্রপক্ষের মধ্যে এ সন্ধি স্বাক্ষরিত হয়। তুর্কী সুলতান ৬ষ্ঠ মোহাম্মদ এ চুক্তি স্বাক্ষর করেন। নিম্নে এ সন্ধির শর্তাবলি দেয়া হলো:
১. তুরস্কের ভৌগোলিক সীমানা সীমিত করা হলো। লোকসংখ্যা হ্রাস করা হলো। যেখানে ১৯১৪ সালে তুরস্কের আয়তন ছিলো ৬,১৩,৫০০ বর্গমাইল যেখানে এ চুক্তির ফলে তুরস্কের আয়তন দাঁড়ায় ১,৭৫,০০০ বর্গমাইল। লোকসংখ্যা ৮০,০০,০০০।
২. এ সন্ধির শর্তানুসারে মিসর, সুদান, সাইপ্রাস, ট্রিপলিটানিয়া, মরক্কো, তিউনিস প্রভৃতি স্থান তুরস্ক ছেড়ে দিলো। এজিয়ান সাগরস্থ কয়েকটি দ্বীপ এবং প্রেসের একাংশ গ্রীসকে দেয়া হলো, সিরিয়া ফ্রান্সকে এবং প্যালেস্টাইন ও মেসোপটেমিয়া ইংল্যান্ডকে দেয়া হলো।
৩. এ সন্ধির শর্তানুযায়ী বিশাল তুর্কী সাম্রাজ্য আনাতোলিয়া ও কনস্টান্টিনোপলে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়লো।
৪. তুরস্কের সৈন্য সংখ্যা ৫০,০০০-এ সীমাবদ্ধ করা হয়
৫. তুরস্কের বিমান বহরগুলোকে মিত্রপক্ষের হাতে ছেড়ে দেয়া হলো এবং কনস্টান্টিনোপল, আলেকজান্দ্রিয়া প্রভৃতি তুরস্কের বন্দরগুলো আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণাধীনে রাখা হলো।
৬. ভান, বিতনিস, আর্জেরুম ও ত্রেব্রজন্দ নিয়ে একটি স্বাধীন আর্মেনীয় রাষ্ট্র গঠন করা হয় এবং তুরস্ক আর্মেনিয়ার স্বাধীনতা স্বীকার করতে বাধ্য হয়।
৭. আর্মেনিয়ার দক্ষিণস্থ ও ইউফ্রেতিস নদীর পশ্চিম দিকের কুর্দ প্রধান জেলাগুলো নিয়ে একটি স্বায়ত্তশাসিত কুর্দ রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
লুসেনের সন্ধি (১৯২৩ সাল)
তুর্কী সুলতান ৬ষ্ঠ মোহাম্মদ (১৯১৮-১৯২২ সাল) সেভার্সের অপমানজনক চুক্তি স্বাক্ষর করলে তুরস্কের জাতীয়তাবাদী নেতা মোস্তফা কামাল পাশার নেতৃত্বে এক প্রবল আন্দোলন শুরু হয়। এজন্য মোস্তফা কামাল পাশাকে সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। মোস্তফা কামাল পাশা জাতীয় পরিষদে যোগ দেন। তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে সেভার্সের চুক্তি বাতিলের প্রস্তাব জোড়ালো হয়।
লুসেন চুক্তি
গ্রীকদের পরাজয় এবং কামালপন্থীদের হুমকির মুখে লয়েড জর্জ মিত্র শক্তির কাছে প্রণালীর ব্যাপারে একটি আবেদন প্রেরণ করে। এতে মিত্র বাহিনীর একটি বাহিনী দার্দানেলিসের পাশে অবতরণ করলে মোস্তফা কামালের বাহিনী অগ্রসর হয়। এতে ইংরেজ ও তুর্কী বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধের অবস্থা সৃষ্টি হয়। কামাল ও ইংরেজদের সাথে চুক্তির মাধ্যমে এর অবসান হয়। এর মাধ্যমে তুরস্ককে পূর্বে থ্রেস এবং আড্রিয়ানোপল ফিরিয়ে দেয়া হয়। মোস্তফা কামাল প্রণালীর ব্যাপারে আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণ প্রস্তাব গ্রহণ করে। তুরস্কের সাথে ১৯২৩ সালে মিত্রপক্ষের দ্বিতীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সর্বপ্রথম বৈঠক বসে তুরস্কের লুসেনে ১৯২৩ সালের জানুয়ারি মাসের ৩১ তারিখে। ইংরেজ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড কার্জন (পরবর্তীতে ভারতবর্ষের বড় লাট), ইতালির মুসোলিনি, ফ্রান্সের পয়ঙ্কারি ও তুরস্কের ইসমত পাশা (ইনোনু) এ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। এবার মিত্র শক্তি আর তুরস্কের উপর অন্যায়ভাবে কোন শর্ত দিতে পারেনি ইসমত পাশার কূটনৈতিক দক্ষতায়। লর্ড কার্জন একগুয়েমি করলে এ বৈঠক ১৯২৩ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি এ বৈঠক বন্ধ হয়ে যায়। ১৯২৩ সালের ২৩ এপ্রিল পুনরায় এ বৈঠক শুরু হয়। এ বৈঠকে লর্ড কার্জন উপস্থিত ছিলেন না। এর ফলে তুর্কীরা তাদের সমস্ত দাবি আদায়ে সমর্থ হয়। সেভার্সের চুক্তির ফলে তুরস্কের যে অপমান, গ্লানী হয় তা থেকে তারা মুক্তি লাভ করে। লুসেনের চুক্তিতে স্বাক্ষরদাতা দেশগুলো হলো- ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, আমেরিকা, ইতালী, রুমানিয়া, রাশিয়া, যুগোশ্লাভিয়া, জাপান, গ্রীস ও তুরস্ক।
লুসেন সন্ধির শর্তাবলি
১৯২৩ সালের ২৪ জুলাই মাসে সম্পাদিত "পুসেন চুক্তির" শর্তাবলি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
১. চুক্তির দ্বারা তুরস্ক মারিৎসা (Maritsa) নদীর তীর পর্যন্ত প্রেসের সব স্থান ও এ চুক্তিও খাল লাভ করে। গ্রীক সীমানা মারিৎসা নদীর তীর পর্যন্ত নির্ধারিত হয়।
অর্থাৎ তুরস্কের ভৌগোলিক সীমারেখা পুনঃনির্ধারিত হয়।
২. পূর্ব থ্রেস ছাড়া তুরস্ককে তার ইউরোপের সব অঞ্চল পরিত্যাগ করতে হয়।
৩. ইতালী দার্দানেনিস দ্বীপপুঞ্জ এবং সাইপ্রাস দ্বীপ লাভ করে। বাকি ইজিয়ান দ্বীপগুলো গ্রীসের কাছে হস্তান্তরিত করা হয়।
৪. লিবিয়া, মিসর এবং সুদানের উপর তুরস্ক আধিপত্য পরিত্যাগ করে।
৫. তুরস্কের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জানমালের নিরাপত্তা প্রদান করা হয়।
৬. ক্যাপিচ্যুলেশনে প্রথা বাতিল করা হয়। এটা আগে বিদেশি খ্রিস্টানদের সম্প্রদায়ের উপর প্রযোজ্য ছিলো।
৭. গ্রীস ও তুরস্কের মধ্যে সম্পাদিত অন্য একটি চুক্তির মাধ্যমে তুরস্কে গ্রীক সম্প্রদায় ও গ্রীসে তুরস্কের মুসলমানরা তুরস্কের চলে আসে। এটা ছিলো স্থায়ী অধিবাসী ব্যবস্থা। ১৩,৫০,০০০ গ্রীক লোক গ্রীসে এবং মেসিডোনিয়া থেকে ৪৩,২০০ তুর্কী মুসলমান আনাতোরিয়ায় চলে আসে।
৮. তুরস্কের সামরিক ও নৌ বাহিনীর উপর কোন বিধি নিষেধ আরোপ করা হয়নি।
৯. দার্দানালিস, মাসুরা এবং বসফোরাস সবার জন্য মুক্ত করে দেয়া হয়। এর ক্ষমতা বি লীগ অব নেশন্সের প্রণালী কমিশনের উপর হস্তান্তর করা হয়।
১০. আর্মেনিয়ানদের ব্যাপারে কোন ঘোষণা দেয়া হয়নি এবং মিল্লাত প্রথা বাতিল করা হয়।
১১. তুরস্কের কাছ থেকে কোন ক্ষতিপূরণ দাবি করা যাবে না।
এ লুসেনের সন্ধি ১৩ বছর (১৯২৩ ১৯৩৬) স্থায়ী হয়
সেভার্স ও লুসেনের সন্ধির মধ্যে তুলনা
সেভার্স চুক্তি ছিলো তুরস্কের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু লুসেনের চুক্তি ছিলো তুরস্কের জন্য মহা বিজয়। এটা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মোস্তফা কামালের এক মহা বিজয়। তুরস্ককে কনস্টান্টিনোপল এবং পূর্ব থ্রেস ফিরিয়ে দেয়া হয়। ওসমানিয়া সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনোপল এবং আড্রিয়ানোপল নিয়ে আন্তর্জাতিক স্বীকৃত প্রকৃত তুরস্ক ভূমি নিয়ে একটি নতুন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। ১৯২০ সালে সেভার্সের চুক্তির মাধ্যমে তুরস্কের উপর অমানবিক আচরণ করা হয়। এ চুক্তির মাধ্যমে তুরস্ককে এক ক্ষুদ্র রাজ্যে পরিণত করা হয়। কিন্তু, ১৯২৩ সালের লুসেন চুক্তি দ্বারা ইউরোপীয় সম্প্রদায় তুরস্ককে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকার করে নেয়। সেভার্সের চুক্তির কারণে যে সব জায়গা তুরস্কের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয় তার অধিকাংশ জায়গা লুসেন চুক্তির দ্বারা তুরস্ক ফিরে পায়। লুসেন চুক্তি ছিলো জাতীয়তাবাদী সরকারের একটি বিরাট সাফল্য। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ড. এম. আবদুল কাদের বলেন, "একটা পরাজিত ও দৃশ্যত বিধ্বস্ত জাতি ধ্বংসস্তূপ হতে উঠে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ জাতিগুলোর সঙ্গে সম্পূর্ণ সমান শর্তে মুকাবেলা করে মহাযুদ্ধে বিজেতাদের কান ধরে নিেেলার সঙ্গে প্রত্যেকটি দাবি আদায় করে নিল, সে অভূতপূর্ব ব্যাপার প্রত্যক্ষ করে জগদ্বাসী বিপিাত্ত হয়ে গেল।"
তুরস্কের ইতিহাসে ১৯২০ সালের সেভার্স ও ১৯২৩ সালের লুসেন চুক্তি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। সেভার্সের চুক্তির মাধ্যমে তুরস্ককে মিত্র শক্তি একেবারে ধ্বংস করে দিতে চায়। ইউরোপ থেকে তুরস্কের নাম নিশানা মুছে ফেলবার এক মহা পরিকল্পনা ছিলো এ সেভার্স চুক্তিতে। কিন্তু, তুরস্কের জাতীয়তাবাদী নেতা মোস্তফা কামাল পাশা তা হতে দেয়নি। তিনি জাতীয়তাবাদে উজ্জীবিত হয়ে তুরস্কের হারানো গৌরব ও ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হন। লুসেন চুক্তির ফলে ইউরোপীয়রা তুরস্ককে স্বাধীন রাষ্ট্র বলে স্বীকার করে নেয়। দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা তুরস্ককে ভাগ বাটোয়ারা করে নেবার ইউরোপীয় যড়যন্ত্র ধ্বংস হয়ে যায়। "ইউরোপের রুগ্ন ব্যক্তি তুরস্ক" একেবারে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। কয়েকজন সাংবাদিক এ লুসেন চুক্তি পরীক্ষা করে একে ইউরোপের উপর এশিয়ার বিজয় বলেছেন। ১৯১৪ সালের প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রকৃত বিজয়ী বলে তুরস্ককে উল্লেখ করা হয়।
ইতোমধ্যে তুরস্কের রাজনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। মোস্তফা কামাল তুরস্কের প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন।
রেফারেন্স বই :
অটোমানদের ইতিহাস
- মাহবুবুর রহমান
COMMENTS