বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প রচনা | রচনা লিখা
বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প: সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত
বা
বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প : সমস্যা ও সম্ভাবনা
বা
পর্যটন শিল্পে বাংলাদেশের সম্ভাবনা
ভূমিকা :
পৃথিবীব্যাপী জ্ঞানী ও প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ ছােটে লােক থেকে লােকান্তরে, দেশ থেকে দেশান্তরে। প্রতিনিয়ত মানুষ জানতে চায়, বুঝতে চায়, জয় করতে চায় অজানাকে। তাই তাে দেখি হিমালয়, চাদের মতাে দুর্গম স্থানকে মানুষ জয় করেছে। পুরাতাত্ত্বিক বিষয় নিয়ে গবেষণা করে উপহার দিয়েছে নতুন পৃথিবী। এ প্রসঙ্গে মহানবি (সঃ) এর একটি বাণী উল্লেখযােগ্য 'জ্ঞান অর্জনের জন্যে সুদূর চীন পর্যন্ত যাও'। অর্থাৎ জ্ঞানের জন্যে, জানার জন্যে সমস্ত বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করতে হয়। পৃথিবীর অন্যান্য স্থানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মতাে বাংলাদেশেরও আনাচে- কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য স্থান, অসংখ্য স্থাপত্য। পরিবর্তনশীল ষড়ঋতুর এদেশ পৃথিবীর বুকে অন্যতম বৈচিত্র্যময় একটি দেশ। তাই দ্বিজেন্দ্রলাল রায় বলেছেন, সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি। বাংলাদেশের অনেক জায়গায় রয়েছে ঐতিহ্যময় পর্যটন স্থান। বিশ্ববিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতার সাথে গলা মিলিয়ে আমরাও বলতে পারি যে, পৃথিবীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ রূপময়ী ও সমৃদ্ধিশালী জাতি ও দেশ হচ্ছে বাঙালি ও বাঙালির দেশ। বাংলাদেশের প্রকৃতি এবং বাঙালি জাতির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার উপায় হচ্ছে পর্যটন
পর্যটন শিল্পের গুরুত্ব :
অন্যান্য শিল্পের মতাে পর্যটনও একটি শিল্প। কথায় আছে, 'গ্রন্থগত বিদ্যা আর পর হস্তে ধন, নহে বিদ্যা নহে ধন হলে প্রয়ােজন। আসলে জীবনভর ভারি ভারি বইপুস্তক পড়ে যতটুকু শেখা সম্ভব তার চেয়ে বেশি সম্ভব যদি চোখে দেখা যায়। কারণ মানুষ তার জ্ঞানের শতকরা ৭০ ভাগ চোখ নামক ইন্দ্রিয় দিয়ে গ্রহণ করে। যে নাকি আগ্রার তাজমহল কিংবা মিশরের পিরামিড বা নায়াগ্রার জলপ্রপাত চোখে দেখেনি সে বই পড়ে তার মর্মার্থ বুঝতে অপারগ। সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষ জ্ঞানপিপাসু। মানুষ ও তার কীর্তি সম্পর্কে এবং প্রকৃতি ও তার মহিমার অজানা রহস্য পর্যটনের মাধ্যমেই জানা যায়। আদিবাসীদের জীবনযাপনের বৈশিষ্ট্য, ইতিহাস ও ঐতিহ্য এবং তাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে মানুষ পর্যটন শিল্পের মাধ্যমে জানতে পারে। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের আচার-আচরণ, স্থান, সৌন্দর্য, পােশাক পরিচ্ছদ, রীতি-নীতি, আকৃতি-প্রকৃতি, প্রাচীনত্বের নিদর্শন, পশুপাখি প্রভৃতি সম্পর্কে পর্যটন শিল্পের মাধ্যমেই জানা যায়। অতএব দেখা যায়, পর্যটন শিল্পের গুরুত্ব ও প্রয়ােজনীয়তা অনস্বীকার্য ।
বাংলাদেশের পর্যটন স্থান:
চিরসবুজ, চিরসুন্দর বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিয়ে পৃথিবীর বড় বড় পণ্ডিত বিভিন্ন রকম সুন্দরের ব্যাখ্যা করেছেন। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের মতাে বাংলাদেশকে নিয়েও মায়াপুরীর স্বপ্ন দেখে মানুষ। বাংলাদেশের আনাচে কানাছে ছড়িয়ে আছে মনমুগ্ধকর পর্যটন স্থান। পর্যটন স্থানগুলােকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। ১. ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান। ২. প্রাকৃতিক পর্যটন স্থান।
ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান:
বাংলাদেশের এমন বেশকিছু সুন্দর মনােরম পর্যটনকেন্দ্র রয়েছে যা ইতিহাসের সাক্ষ্য দেয়। বাংলার প্রাচীন নিদর্শন এসব। বাংলার অতীত ঐতিহ্যের পীঠস্থান এসকল নির্দর্শন ।এমন কিছু স্থান হলাে লালবাগ কেল্লা, আহসান মঞ্জিল, সাতগম্বুজ মসজিদ, মহাস্থানগড়, ময়নামতি-শালবন বিহার, ওয়ারি বটেশ্বর, পানাম নগর, সােনারগাঁ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, আবেগের সাথে জড়িত আরাে এমন কিছু বিশেষ স্থান হলাে জাতীয় শহীদ মিনার, স্মৃতিসৌধ, রায়ের বাজার বধ্যভূমি। এই স্থানগুলাে আমাদের জাতীয় চেতনার সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত।
প্রাকৃতিক পর্যটন স্থান:
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছেন অনেক কবি, দার্শনিক, পর্যটক। স্রষ্টার অফুরন্ত দানে সজ্জিত বাংলার প্রকৃতি। এদেশের সিলেট, বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, কক্সবাজার যেন অকৃত্রিম মায়ামন্ত্রকর সৌন্দর্য দিয়ে বাংলাদেশকে করেছে সমৃদ্ধ। এমনই কিছু চোখজুড়ানাে স্থান হলাে নীলগিরি, নীলাচল, সাজেক, নাফাখুম, আমিয়াখুম, কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন, সুন্দরবন, বিছানাকান্দি, রাতারগুল, জাফলং, লালাখাল, খৈয়াছড়া ঝর্ণা। কোনােটি পাহাড়, কোনােটি সমুদ্রসৈকত, কোনােটি বন আবার কোনােটি খুম। অদৃশ্য সৌন্দর্য শক্তি পর্যটকদের আকর্ষণ করবে পরম শান্ত রূপ নিয়ে।
পর্যটকদের সুযােগ সুবিধা:
পূর্বে পর্যটকদের জন্য বাংলাদেশে তেমন কোনাে সুযােগ সুবিধা ছিল না। পর্যটক শিল্পও তেমন বিকাশ লাভ করেনি। সম্প্রতি সরকার পর্যটক সুযােগ-সুবিধা বাড়ানাের জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ নিয়েছে। বেসরকারি হােটলের পাশাপাশি তৈরি করা হয়েছে সরকারি হােটেল, মােটেল। কমখরচে রিজার্ভেশন দেওয়া হচ্ছে। যাতায়ত ব্যবস্থা উন্নত করা হয়েছে। পর্যটন শিল্পকে বিকশিত করতে স্থাপিত হয়েছে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন।
বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের যাবতীয় সমস্যা:
বাংলাদেশ পর্যটন শিল্পে কিছু সমস্যা এখনাে বিদ্যমান। পর্যটন কেন্দ্রগুলাতে দৈনন্দিন পর্যটক যাতায়তের নির্দিষ্ট নির্ধারিত সীমা নেই। পর্যাপ্ত সংরক্ষণ ব্যবস্থা নেই। পয়নিষ্কাশন সমস্যা রয়েছে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার চরম ঘাটতি রয়েছে। এর কিছু ফলাফলও আমরা পেয়েছি। যেমন: কক্সবাজারে সামুদ্রিক প্রাণীর সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে সমুদ্রে বর্জ্য, প্লাস্টিক নিক্ষেপের ফলে। সুন্দরবনের প্রাণী সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে, বৃক্ষ নিধন ও পশু শিকারের ফলে। অপার্থিব সৌন্দর্যের আধার সেন্টমার্টিন সমুদ্র সৈকত ধ্বংসের পথে। পর্যাপ্ত পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থা ও পর্যটক সীমা না থাকার কারণে আজ তার এই দশা। এ সমস্যা নিরসনের লক্ষ্যে ২০১৯ সালের ১লা মার্চ থেকে রাত্রিযাপন নিষিদ্ধ হচ্ছে সেন্টমার্টিন দ্বীপে। সরকারের যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ এবং নাগরিক সচেতনতা পারে আমাদের এই অমূল্য সম্পদগুলাে রক্ষা করতে।
পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে পর্যটন করপােরেশনের দায়িত্ব :
বাংলাদেশ পর্যটন শিল্পে সমৃদ্ধ। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য দুর্লভ এবং সুন্দর স্থান। এ স্থানগুলােকে সংরক্ষণের জন্যে পর্যটন করপােরেশনের বিশেষ দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমকে ব্যবহার করে বাংলাদেশের পর্যটন স্থানগুলােকে বিশ্বের মানুষের চোখের সামনে তুলে ধরতে হবে। থাকার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে এবং যাতায়াত ব্যবস্থা সহজ ও স্বল্পব্যয়ের আওতায় আনতে হবে। পর্যটন কেন্দ্রগুলােতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে দর্শনীয় জায়গাগুলাের ছবি প্রদর্শন করার মাধ্যমে দেশি বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করতে হবে। তাহলেই পর্যটন শিল্পে বাংলাদেশের স্থান বিশ্বের সুউচ্চ স্থানে অধিষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে পর্যটন করপােরেশনের দায়িত্ব ও কর্তব্য অপরিসীম।
উপসংহার :
প্রখ্যাত শিল্পী, সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায় আধুনিক পর্যটন শিল্পনগরী ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন- 'অর্ধেক সুন্দরী তুমি, অর্ধেক কল্পনা। তাঁর এ মন্তব্য সম্পর্কে আমরাও বলতে পারি, প্যারিসের অর্ধেক সৌন্দর্যকে কল্পনা করে নিতে হয় অথচ আমাদের বাংলাদেশের সবুজ, শ্যামল সৌন্দর্যকে কল্পনা করে নিতে হয় না। তা একই সাথে দৃশ্যমান ও অনুভব্য। বাংলাদেশের পর্যটন স্থানের সৌন্দর্যের তুলনা হয় না। বাংলাদেশে পর্যটন করপােরেশন, বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সর্বোপরি সকলেই একটু সচেতন হলে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প বিশ্বের মধ্যে শ্রেষ্ঠ আসনে আসীন হবে।
COMMENTS